এভাবেই নিজের অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্তের কথা জানান মেহেরপুরের বেতবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ইমারুল ইসলাম। তার মতো অনেকেই অসুস্থ পশুর মাংসের সংস্পর্শে এসে সংক্রামক এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
মেহেরপুরে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। চলতি বছরে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬৪ জন। অসুস্থ পশু জবাই ও তার মাংস থেকে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রামক এই রোগ। ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগের ভূমিকাকে দুষছেন স্থানীয়রা।
জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, মেহেরপুর জেলায় চলতি বছরে ৪৬৪ জন অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত রোগীর ৯৭ শতাংশই গাংনী উপজেলার বাসিন্দা। উপজেলার কাজীপুর, বামুন্দি, ছাতিয়ান ও মোটমুড়া ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে হানা দিয়েছে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ অ্যানথ্রাক্স। বেশিরভাগ সময় স্থানীয়ভাবেই চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। অবস্থা বেগতিক হলে সরকারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হয় এ অঞ্চলের মানুষ।
রোগাক্রান্ত পশুর মাংস খাওয়া ও এর সংস্পর্শে এ রোগে আক্রান্ত হলেও অনেকেই জানেন না এর ভয়াবহতা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়ার মাংস স্পর্শ করাতে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ছে এই রোগ। তবে এই রোগের জীবাণু মাটিতেও থাকে বলে জানিয়েছেন তারা।
বাওট গ্রামের চাদনি খাতুন বলেন, ‘বাজার থেকে গরুর মাংস কিনে আনেন আমার স্বামী। সেই মাংস রান্নার জন্য প্রস্তুত করি। সেসময় আমার দুই হাতের আঙুলে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। পরে সেখানে ফোসকা পড়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়। পরে চিকিৎসা নিয়ে জানতে পারি, আমার অ্যানথ্রাক্স হয়েছে।’
উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন কাজিপুর গ্রামের সাইদুরের স্ত্রী পারভিনা। পরীক্ষায় তার শরীরেও অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়। পরে ১৫ দিন চিকিৎসা নিতে হয় তাকে।
কাজীপুর গ্রামের আফাজউদ্দিন বাজারে মাংসের ব্যবসা করেন। রোগাক্রান্ত গরুর মাংস নাড়াচাড়া করার কারণে তার শরীরে প্রথমে ক্ষত সৃষ্টি হয়। পরে পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্স রোগ ধরা পড়ে। একই উপজেলার হাড়াভাঙ্গা গ্রামের মালেক মোল্লা জানান, তিনি বাজার থেকে গরুর মাংস কিনে আনেন। সেই মাংস নাড়াচাড়া করার কারণে তার শরীরে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ে।
অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন গাড়াবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাড়ির একটি অসুস্থ ছাগল জবাই করার পর ডান হাতের একটি আঙুলে ফোড়ার মতো দেখা দেয়। পরে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা জানান, অ্যানথ্রাক্স হয়েছে। টানা আট মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ঘা শুকিয়ে যায়।
গাংনী উপজেলার তহবাজারের মাংস বিক্রেতা জবান মণ্ডল বলেন, ‘গরু বা ছাগলের মাংস কাটা ও বিক্রি করার সময় খালি হাত ব্যবহার করা হয়। এ কারণে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।’
তবে ভ্যাকসিন প্রাপ্যতা নিয়ে প্রাণিসম্পদ বিভাগের প্রতি অভিযোগ এলাকাবাসীর। স্বাস্থ্য বিভাগের সচেতনতা কার্যক্রম, অসুস্থ পশু জবাই ও বিক্রি রোধে কোনো পদক্ষেপ নেই বলে জানান স্থানীয়রা।
গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিলে শরীরে ব্যাকটেরিয়ার স্পোর থেকে যায়, যা বিপদজনক। তাই এ ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা দিলেই হাসপাতালে আসার আহ্বান জানান গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. ফারুক হোসেন।
তিনি বলেন, ‘যাদের শরীরে ঘা কিংবা খোস-পাঁচড়ার মতো কোনো ক্ষত থাকে, তারা অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণুতে খুব দ্রুত আক্রান্ত হন। তবে রান্না করা মাংসে এ জীবাণুর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।’
গবাদিপশুর মাংস খুবই সতর্কতার সঙ্গে নাড়াচাড়া করতে হবে।
অবশ্যই হাতে গ্লাভস পরে পশুর মাংস স্পর্শ করা উচিত। তারপরও কারও শরীরে এমন লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।
গাংনী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোত্তালেব আলী বলেন, গবাদিপশুকে শতভাগ ভ্যাকসিনেশনের আওতায় নিয়ে এলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব কমে যাবে।
তিনি বলেন, মাত্র ৩০ হাজার অ্যানথ্রাক্স টিকা এসেছে। এরমধ্যে ২০ হাজার গবাদিপশুকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে লোকবলের অভাব ও পর্যাপ্ত টিকা সরবরাহ না থাকায় অ্যানথ্রাক্স রোগ নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডা. একেএম আবু সাঈদ বলেন, ‘এ রোগ চামড়ায় দেখা দিলেও ফুসফুস ও খাদ্যনালী আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে।
সামাজিক সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সচেতনতা কার্যক্রম চালু রয়েছে।’